Top Ad unit 728 × 90

Breaking News

সংবাদ

কর্ডোভা : জ্ঞানবিজ্ঞানের স্বপ্নপুরী


জনপ্রিয় অনলাইন : জ্ঞানবিজ্ঞানে কর্ডোভার খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। এই নগরীর প্রত্যেক নরপতিই ছিলেন বিদ্যানুরাগী ও জ্ঞানসেবক। জ্ঞানবিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কর্ডোভাই ছিল ইউরোপের পথপ্রদর্শক। প্রখ্যাত মুসলিম ভূগোল বিশারদ ইয়াকুত আল হামাবির মতে, কর্ডোভা ছিল গোটা আন্দালুসের প্রাণকেন্দ্র।

স্পেন মুসলিমদের প্রথম করতলগত হয় মুর জাতির মাধ্যমে। মুসলিমরা বিজিত ভূখ-ের রাজধানী হিসেবে কর্ডোভাকেই বেছে নেয়। শুধু ভূখ-ের দখল নয়, বরং এর সার্বিক উন্নয়নের প্রতি পুরো মনোনিবেশ করেন মুসলিম শাসকরা। খলিফাদের নিয়োগ করা মোট তেইশ জন প্রশাসক এই ভূখ- শাসন করেছিলেন। তবে ৭১৬ সালে এটি দামেস্কের কেন্দ্রীয় খেলাফতের অধীনে চলে যায়। পরবর্তীতে ৯২৯ থেকে ১০৩১ পর্যন্ত এখানেই একটি স্বতন্ত্র খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় পরিসরকেই কর্ডোভার ঐশ্বর্য ও জ্ঞানবিজ্ঞানের সোনালি যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।  
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, একাদশ শতাব্দীতে জ্ঞানবিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি সর্বক্ষেত্রেই কর্ডোভা হয়ে উঠেছিল গোটা বিশ্বের অগ্রণী নগর। ইউরোপের বহু খ্রিস্টান বিদ্যা অর্জনের জন্য পাড়ি জমিয়েছিলেন এই নগরীতে। তাদের অনেকে পেশাজীবী হিসেবে এই শহরেই বাস করতেন। অনেকে এখান থেকে বিদ্যা আহরণ করে পিরেনিজ পর্বতমালা পাড়ি দিয়ে চলে যান ইউরোপে। তখন তারাই হয়ে যান অবশিষ্ট ইউরোপের মহাজ্ঞানী। পরবর্তী সময়ে ইউরোপের শিল্প, সাহিত্য ও সভ্যতায় সেকালের কর্ডোভার প্রভাব পরিদৃষ্ট হয়। নগর সভ্যতার এতটা উৎকর্ষ সে কালের আর কোনো নগরীর ভাগ্যে জোটেনি। সে সময় গোটা কর্ডোভায় পাঁচ শতাধিক লাইব্রেরি ছিল। তৎকালীন ইউরোপে গোসলখানাকে হারাম বলে গণ্য করা হত, অথচ কর্ডোভাতে ছিল ৯০০ পাবলিক বাথ। দশম শতকে কর্ডোভাতে ছিল ৭০০ মসজিদ। অবশ্য পরবর্তী সময়ে ১৫৬৭ সালে এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আন্দালুসের মুসলিম শাসনামলে নির্মিত সকল হাম্মাম (গোসলখানা) ভেঙে দেয়া হয়।
শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান সাধনায় নয়, বরং অর্থনৈতিক উন্নয়নেও কর্ডোভা ছিল সেকালের রোল মডেল। চামড়া, লোহা, সুতা, রেশম এবং বস্ত্রসহ বহুমুখী উৎপাদনের কেন্দ্রও ছিল এই কর্ডোভা। ইউরোপের বিভিন্ন রাজা-বাদশাহদের কাপড় তৈরি হতো এই ভূখ-েই। কৃষিখাতেও কর্ডোভা ছিল বহু এগিয়ে। সে কালের চাকা ব্যবস্থার মাধ্যমে সেচ কাজ পরিচালিত হতো। মরুময় আরবের কঠোর পরিশ্রমী জাতি এখানে সোনার ফসল ফলাতে লাগল। নানা ধরনের সবজি ও ফলফলাদি বেশ সহজেই উৎপাদন হচ্ছিল। এসব উৎপাদন কর্ডোভার অর্থনীতিকে বহুদূর এগিয়ে নিয়েছিল। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বায়ুকলের ব্যবহার গোটা ইউরোপের মাঝে এই ভূখ-েই সর্বপ্রথম হয়েছিল।
    
চলতি সময়ের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের প্রফেসর রগার কলিন্স কর্ডোভা প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘আরব মুসলিমরা একটি যুদ্ধপ্রবণ ভূখ-কে পুরো শান্তির আবাস বানিয়েছিল।স্পেনের প্রত্যেক শাসকই ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও গুণগ্রাহী। তন্মধ্যে তৃতীয় আবদুর রহমান, হাকাম (২য়) এবং মনসুরের নাম বিশিষ্টতার দাবিদার। তারা ছিলেন মূলত মুসলিম স্পেনের স্বর্ণযুগের পৃষ্ঠপোষক বোদ্ধাশাসক। স্পেনের এ সোনালি অধ্যায় সৃষ্টিতে যারা অগ্রণী ছিলেন, তারা হলেন বিজ্ঞানী, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি কর্মী। গোটা স্পেনেই ছিল জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চার এক আদর্শভূমি। বিশিষ্টদের মধ্যে দার্শনিক ইবনে মাসারাহ (৯৩১), ঐতিহাসিক ইবনুল আহমার (৯৬৯), জ্যোতির্বিদ আহমদ বিন নসর (৯৪৪), মাসলামাহ বিন কাসিম (৯৬৪), চিকিৎসক আরিব বিন সাঈদ, ইয়াহিয়া বিন ইসহাক অন্যতম। কুরতুবী (রহ.) এর বিখ্যাত তাফসির আল জামি লি আহকামিল কুরআনআজও মুসলিম বিশ্বের লাইব্রেরির অনন্য সংযোজন। ইমাম কুরতুবী (রহ.) ছিলেন এই মাটির স্বর্ণসন্তান। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব জ্ঞানীই উপযুক্ত মর্যাদা পেতেন। গ্রিক প-িত নিকোলাস, ইহুদি প-িত হাসদাই তার দরবারে সম্মানিত হন। ইউরোপের শিল্পবিপ্লব থেকে শুরু করে জ্ঞান সংস্কৃতি সবখানেই কর্ডোভার সেই সোনালি যুগের প্রভাব অনস্বীকার্য।
তৃতীয় আবদুর রহমান (৯১২-৯৬১) এর সময় বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে ছাত্র এবং বিদ্যান ব্যক্তিরা কর্ডোভায় সমবেত হন। তাই তখন কর্ডোভাকে বলা হতো প-িতাশ্রম। কর্ডোভা নগরী থেকে সাড়ে ছয় কিলোমিটার পশ্চিমে তৃতীয় আবদুর রহমান গড়েছিলেন দুনিয়াখ্যাত প্রাসাদ মদিনাতুজ জাহরা। প্রায় সুদীর্ঘ ৮০ বছর সময় ব্যয় করে তিনি এই প্রাসাদ গড়েছিলেন। এতটা সমৃদ্ধ প্রাসাদ সে সময় গোটা ইউরোপেই বিরল ছিল। সে কালের বেশ কজন ইউরোপিয়ান পরিব্রাজক এ প্রাসাদের উচ্চতার স্বীকৃতি দিয়েছেন।
এই নগরীতেই ১৭০ হিজরিতে নির্মিত হয় বিখ্যাত কর্ডোভা জামে মসজিদ। এ
  মসজিদের নির্মাণশৈলী ও সৌন্দর্যের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। স্পেনে মুসলিম পতনের পর এই মসজিদকে গির্জায় রূপান্তরিত করা হয়। মসজিদটি এখনো সেভাবেই আছে। অবশ্য ১৯৭৭ সালে সৌদি বাদশাহ ফয়সাল স্পেন ভ্রমণে গেলে তখন একবার সে মসজিদে নামাজের অনুমতি দেয়া হয়। এই মসজিদটি ইউনেস্কো কর্তৃক ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত।
তবে সুখের সময় খুব বেশি স্থায়ী হয়নি। ১১শ শতকের দিকে খেলাফত ভেঙে যায় এবং অসংখ্য ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যেগুলোকে বলা হতো তাইফা। এতেও রক্ষা হলো না। মুসলিম সাম্রাজ্য ছোট হতে হতে একেবারে গ্রানাডার মানচিত্রে সীমায়িত হয়ে পড়ে। এ গ্রানাডাই ছিল আন্দালুসের শেষ মুসলিম শহর। তারপরের ইতিহাস শুধু অশ্রু আর রক্তের। গ্রানাডার শেষ শাসক মুহাম্মদ। ১৪৯১ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে রাজা ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার সেনাবাহিনী গ্রানাডা শহর চতুর্দিক দিয়ে ঘেরাও করে ফেলে। সুলতান মুহাম্মদ তার আল হামরা প্রাসাদের মিনার থেকে দেখতে পায় যে, খ্রিস্টান বাহিনী গ্রানাডা শহর বিজয়ের জন্য জড়ো হচ্ছে এবং আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে মুহাম্মদ সবকিছু অন্ধকার দেখতে পায় এবং শেষমেশ কোনো উপায়ান্তর না দেখে ১৪৯১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে খ্রিস্টানদের সঙ্গে একটি চুক্তি করে যা খ্রিস্টানদের গ্রানাডা শহরের নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দেয়া হয়। ২ জানুয়ারি ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে এই চুক্তি কার্যকর হয় এবং স্পেনীয় বাহিনী গ্রানাডায় প্রবেশ করে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দালুসের সর্বশেষ মুসলিম রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তবে মুসলিম কর্ডোভা আজও আপন বিভা ছড়ায় ইতিহাসের আড়ালে।

কর্ডোভা : জ্ঞানবিজ্ঞানের স্বপ্নপুরী Reviewed by JONOPRIO24 on ৯:৫৯:০০ PM Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

All Rights Reserved by স্পেনে অফিসিয়াল তথ্য © 2014 - 2015
Powered By Blogger, Shared by Free WP Themes

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.